হযরত শাহ সূফী আমানত খান (র.)


হযরত শাহ সূফী আমানত খান (র.)

১৩৪০ খ্রীষ্টাব্দে সোনার গাঁওয়ের স্বাধীন সুলতান ফখরুদ্দীন মোবারক শাহর সেনাপতি কদলখান গাজির সহায়তায় পীর বদরুদ্দীন আল্লামা তাঁর সহচরদের নিয়ে মগদস্যুদের পরাস্ত করে চট্টগ্রাম জয় করলে এখানে ইসলামী শাসনের সূচনা হয় কথিত আছে যে খ্যাতনামা বারোজন সূফীসাধক ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে চট্টগ্রাম এসেছিলেন চট্টগ্রামস্থ সীতাকুণ্ড থানার সোনাইছড়ি অঞ্চলে যা পরবর্তীকালে বার আউলিয়া নামে সর্বত্র প্রচারিত ও প্রকাশিত তথায় তাঁদের আস্তানা দৃষ্ট হয় বাংলাদেশের মুর্শিদাবাদ, জাহাঙ্গীর নগর ও ইসলামাবাদ মুঘল আমলের শেষের দিকে সূফীদের আধ্যাত্মিক সাধনার কেন্দ্র হিসাবে ব্যাপক প্রসার লাভ করে হযরত শাহ সূফী বখতেয়ার মাহি সওয়ার (র.) প্রমুখ আরবীয় সূফী ঐ সময় চট্টগ্রামে এসে বসতি স্থাপন করেছিলেন তাই চট্টগ্রাম সূফী সাধকদের প্রবেশদ্বার রূপে চিরকাল চিহ্নিত হয়ে থাকবে
চট্টগ্রাম পাহাড় পর্বত ঘেরা নির্জন পরিবেশ মন্ডিত এলাকা এ অঞ্চলের পশ্চিম তটে যেখানে বঙ্গোপসাগরের ফেনিল জলরাশি যুগ যুগ ধরে আছড়ে পড়ছে তার পিছনে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ধ্যানমগ্ন জালালাবাদ পাহাড় চট্টগ্রামের এই প্রকৃতি পরিবেশ যেন রাব্বুল আলামীন শুধু সূফীদের আত্মিক ক্রিয়াকলাপের জন্য বিশেষভাবে তৈরি করেছেন তাই চট্টগ্রামের সাথে সূফী সাধকদের চমৎকার আধ্যাত্মিক ও জাগতিক যোগাযোগ লক্ষ্যনীয়
কোন এক সময় কাদেরীয়া তরীকার প্রবক্তা প্রখ্যাত সাধক বড়পীর হযরত মহিউদ্দিন আবদুল কাদের জিলানী (র.) এর বংশধর ভারতের বিহারে এসে বসতি স্থাপন করেছিলেন মরমীবাদের ব্যাপক প্রচারণা খোদা প্রেমিক পুরুষদের হৃদয়ে ভীষণভাবে নাড়া দেয়, ফলে বড়পীর ছাহেবের বংশোদ্ভূত ত্যাগী পুরুষ শাহ সূফী আমানত খান (র.) বিহার শরীফের নিজ পিত্রালয় ত্যাগ করে আধ্যাত্মিক জগতের আকুল ইশারায় আত্মিক জ্ঞানার্জনের জন্য সুদূর কাশ্মীরের পথে চলে যান এখানে এসে তিনি উপযুক্ত মুর্শিদের খোঁজ করতে থাকলেন নীরবে কাশ্মীরের জনৈক বুজর্গ ব্যক্তি তাঁকে মহান অলী হযরত আবদুর রহিম শহীদ (র.) এর সন্ধান বলে দেন
তাঁর কাছে জানতে পারলেন আবদুর রহিম শহীদ (র.) ঐ সময় লক্ষ্ণৌ অবস্থান করছেন অতঃপর লক্ষ্ণৌ এসে জানতে পারলেন মাত্র অল্পকাল হলো তিনি মখসুসাবাদ (মুর্শিদাবাদ) চলে গেছেন এরপর হযরত এল্‌ম মারিফাতের অমোঘ আকর্ষণে লক্ষ্ণৌ থেকে মখসুসাবাদে এসে পৌঁছলেন অতঃপর প্রেমাস্পদ তাঁর প্রিয়তমের সন্ধান পেলেন হযরত শহীদ এর করুণা দৃষ্টি তার পরে নিপতিত হলো হযরত আবদুর রহিম শহীদ (র.) এর কর চুম্বনের মাধ্যমে তিনি এল্‌ম মারিফাতে দীক্ষা গ্রহণ করলেন সেই জ্যোতির্ময় পুরুষের সান্নিধ্য পেয়ে হযরত অত্যন্ত গৌরবান্বিত হলেন মাত্র অল্পকালের মধ্যে তিনি মুর্শিদের সাহচর্য থেকে এল্‌ম বাতেন শাস্ত্রে চরমোৎকর্ষতা লাভ করে অফুরন্ত নেয়ামত হাসিল করলেন পীর ছাহেব বুঝতে পারলেন শাহ আমানতের অন্তর আল্লাহ প্রেমের জোয়ারে পরিপূর্ণ এবং রাব্বুল আলামীনের সাথে মিলনাকাঙক্ষায় মন তাঁর উন্মুখ এমন এক প্রেমাস্পদের সন্ধান পেয়ে মুর্শিদ অত্যন্ত আশান্বিত হলেন একান্ত মনোযোগের সাথে তাঁকে আধ্যাত্মিক শিক্ষা দান করতে থাকেন কথিত আছে যে, হযরত তদীয় মুর্শিদের খেদমতে ১২ বৎসর অতিবাহিত করেছেন হযরতের ঐশী ক্ষমতার ব্যাপকতা দর্শন করে মুর্শিদ তাঁকে কাদেরীয়া, নকশবন্দীয়া এবং মাদারীয়া তরীকায় খেলাফত প্রদান করতঃ বিবাহিত জীবন যাপনের মাধ্যমে হালাল উপার্জন করার উপদেশ দিয়ে পূর্বাঞ্চলীয় শহর চট্টগ্রাম যেতে নির্দেশ দিলেন ১১২০ হিজরী সনে হযরত শহীদ (র.) তদীয় ভ্রাতুষ্পুত্র হযরত নাজিমুদ্দীনকে নিয়ে মখসুসাবাদ ত্যাগ করে ঢাকায় তশরীফ নিয়ে এলেন এখানে এসে তিনি লক্ষ্মীবাজারে একটি খানকাহ স্থাপন করে ইসলাম প্রচারে আত্মনিয়োগ করেন চট্টগ্রামের আত্মিক জগতের কর্তৃত্বের ভার গ্রহণ করে শাহ সূফী আমানত খান (র.) অত্যন্ত ধন্য হলেন এদিকে চট্টগ্রাম শহরে এসে তিনি সরওয়ারে কায়েনাত হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা (স.) এর সুন্নত পালনার্থে জীবিকা নির্বাহের তাগিদে স্থানীয় আদালতে সামান্য একটি চাকরি জুটিয়ে নিলেন (ঐ সময়কার নবাবী আমলের আদালতটি পরবর্তীকালে মোহসেনিয়া মাদ্রাসা এবং তারও পরে মহসিন কলেজ হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে) অতঃপর দিনের বেলায় হযরত আদালতের কাজে এবং রাত্রি বেলায় আধ্যাত্মিক সাধনায় ব্যাপৃত হলেন পার্থিব জগতের মায়া মমতা তাঁকে আর গৃহাভিমুখী করতে পারলো না আদালতে কাজের ফাঁকে ফাঁকে তিনি এবাদত বন্দেগীর জন্যে একটি নিরিবিলি স্থানের খোঁজ করছিলেন অতঃপর একদিন আন্দরকিল্লা পাহাড়ের পাদদেশে পীর বদরুদ্দিন আল্লামার সমাধির কিছুটা পশ্চিমে বদর পুকুরের পশ্চিম পাড়ে একটি নিরিবিলি স্থান নির্বাচন করে তথায় তিনি খানকাহ স্থাপন করেন পরবর্তীকালে ঐ স্থান খানকাহ আমানতিয়া নামে প্রসিদ্ধি লাভ করে
চট্টগ্রামের সরল প্রাণের সাধারণ মানুষ তখন একজন ঐশ্বরিক ত্রাণকর্তার প্রয়োজন অনুভব করছিলেন এদিকে হযরত শাহ সূফী আমানত খান (র.) লোক চক্ষুর অন্তরালে আত্মিক কার্যকলাপ চালিয়ে যেতে থাকেন বস্তুতঃ তিনি সুন্নতের অত্যন্ত বিনয়ী অনুসারী ছিলেন বিধায় হালাল পন্থায় রোজগার করে জীবিকা নির্বাহের জন্য অত্যন্ত সচেষ্ট ছিলেন তিনি সাধারণ লোকের মন জয় করতে পেরেছিলেন তাঁর নম্র ব্যবহার, পরম ধৈর্যগুণ এবং মৌনতার দ্বারা তাই তাঁকে স্থানীয় বাসিন্দারা সমীহ করতে তাঁর এ সমস্ত গুণাবলীর জন্যে
লালদীঘি অঞ্চলে ঘন অরণ্যরাজির ভিতর স্থিত কুঠিরে নীরবে প্রভুর আরাধনা করতেন হযরত শাহ সূফী আমানত খান (র.) কুঠিরে তখন নীরব আঁধার ছিলো তাঁর সহচর মৌনতা, সরলতা এবং বিশ্বস্ততার কারণে স্থানীয় জনসাধারণের কাছে তিনি মিয়া ছাহেব নামে পরিচিত ছিলেন কর্মক্ষেত্রে তিনি ছিলেন অত্যন্ত দক্ষ এবং নিরলস কর্মী কোন প্রকার শিথিলতা ব্যতীত প্রতিদিন সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত তিনি আদালতে কাজ করতেন আদালতের সামান্য চাকরি গ্রহণ করে তিনি বড় ছোট ভেদাভেদ তুলে দিয়ে ইসলামের সাম্যতার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েছিলেন আধ্যাত্মিক জগতের এতবড় সূফী হয়েও তিনি পার্থিব প্রতিপত্তির মোহে আচ্ছন্ন হননি আদালতের কর্মজীবন তাঁকে সুন্নতের পায়রবী করতে সাহায্য করেছে খেটে জীবিকার্জনের মাধ্যমে খোদার স্মরণ চালু রাখতে তিনি সচেষ্ট ছিলেন একজন বেলায়েত প্রাপ্ত সূফী হয়েও সামান্য চাকরি গ্রহণ করে তিনি সুন্নতের প্রতি অসীম অনুরাগ দেখিয়েছেন
হালাল পন্থায় উপার্জন তাঁর অসাধারণ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের পরিচায়ক সমাজপতিদের ধন দৌলতের গর্বকে তিনি আল্লাহ পাকের ইচ্ছায় ঐশী ক্ষমতার বলে অগ্নিস্নাত করে দিয়েছিলেন প্রায় সময় তিনি নীরবতা অবলম্বন করতেন বলে তাঁর চরিত্রের এক রিবাট অধ্যায় অজ্ঞাত রয়ে গেছে নিজের কোন প্রকার প্রচারণাকে তিনি প্রাণভরে ঘৃণা করতেন তাঁর কাছে আদবের অত্যন্ত সমাদর ছিলো কিন্তু বে-আদবকে তিনি কখনো প্রশ্রয় দিতেন না
তদীয় একমাত্র ঔরশজাত পুত্র শাহজাদা মুহাম্মদ আনোয়ার খানকে খানকাহ শরীফ এবং নিজ বসতবাড়ির তদারকির ভার ন্যস্ত করে এই মহিমামন্ডিত সূফী তাত্ত্বিক হযরত শাহ সূফী আমানত খান (র.) ১১৮৭ হিজরীর ৩০ শে জিলক্বদ খানকাহ্‌ শরীফে ইন্তেকাল করেন
বাংলাদেশের মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, সকলেই তাঁর সমাধিতে মনের আকুতি নিবেদন করে শাহ সূফী আমানত খান (র.) তাই সাধারণ মিয়া ছাহেবের গন্ডি পেরিয়ে এখন একজন ঐশ্বরিক ত্রাণকর্তা তাঁর সমাধিতে খুশবুদার রঙিন গিলাফ মোড়ানো মকবরার সৌরভে মাতোয়ারা হয়েছে ভক্তকুল যিনি যত বেশি প্রেমিক তিনি তত বেশি রূহানী ফয়েজ লাভ করতে পারেন প্রিয়জনের মৃত্যুবার্ষিকীতে যেমন প্রেমিক প্রবর পাগল প্রায় দিশেহারা হয়ে পড়েন তেমনি হযরতের ভক্তরা তাঁর পবিত্র ওরশ শরীফে এসে অসীম শ্রদ্ধায় রোদন করতে থাকেন এমন একদিন ছিলো যেদিন তিনি হাকিম ছাহেবের পাখা টেনে দিনাতিপাত করতেন আজ তিনি অসহায় দুঃখপীড়িত ভক্তবৃন্দের পোড়ামনে শান্তির পাখা টেনে স্বর্গীয় সুখ দান করে চলেছেন
হযরতের বংশধরগণ ওয়াক্‌ফনামার বিধানমতে বংশ পরম্পরায় পুরুষানুক্রমে দরগাহ্‌ শরীফের মুতওয়াল্লী হিসেবে হযরতের ভক্তগণের খেদমতে নিয়োজিত থেকে অত্যন্ত সুন্দর ও শৃঙ্খলতার সাথে শরীয়ত সম্মতভাবে যুগ যুগ ধরে হযরতের পবিত্র ওরশ শরীফ পরিচালনা করে আসছেন
তথ্য সূত্র-দৈনিক আজাদী

কলম সম্রাট ইমাম গায্‌যালী


ভূমিকা :- ইমাম গায্‌যালী। এটি কোন অপরিচিত বা কোন নতুন নাম নয়। মানুষের আত্নিক উন্নয়ন সাধনের জন্য তিনি রেখে গেছেন একসাগর অবদান। মানব জাতির জ্ঞান ভান্ডারে ইমাম গায্‌যালীর গ্রন্থরাজি হীরক খন্ডের মতো বর্ণালি আলো ছড়িয়ে চলছে নিত্য দিবস, হউক সে, মুসলিম বা অন্য কিছু। তিনি মূলত ৫ম শতাব্দীতে প্রকাশিত নূর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর মোজেযা। যখন মুসলমান হিংসা, বিদ্বেস,অহংকার, গিবত, লোভ, হারাম, কীবর, কিজব, কিনা, ফাসাদ, বখিল রোগে আক্রান্ত্ম হয়ে কিংকর্তব্যবিমূড় হয়ে স্ববিরোধী কার্যালাপে মন দিয়ে ঝুকে পরেছিল সেই সময়, নয় পূর্বে কিংবা পরে, এসব থেকে মানুষকে তার আসল স্বভাবকে ইয়াদ করিয়ে দিয়েছেন ইমাম গায্‌যালী। তিনি মানুষকে তওবা, এনাবত, যোহদ, শুকর, তায়াক্কুল, কানাত, তাসলিম, রেজা, সবুর নামে এসব গুনে গুনান্বিত হওয়ার উদাত্ব আহ্ববায়ক। ইমাম গায্‌যালীকে তাসাউফের জীবন দাতা ও বলা হয়। এ বিশাল মনীষীর বর্নাঢ্য জীবন থেকে, সামান্য থেকে সামান্য নিম্নে অংকন করলাম এজন্য যে, যাতে সেই ঐতিহ্য ও তাসাউফ আবার স্বরণ করি।
জন্ম :-
ইমাম গায্‌যালীর জন্ম স্থান নিয়ে ঐতিহাসিক গনের মধ্যেমত বিরোধ বিদ্যমান। আল্লামা সামানী বলেন- ইরান এর খোরাসানের তুস প্রদেশের গায্‌যালানামক গ্রামে ইমাম গায্‌যালী জন্ম গ্রহণ করেন। কিছু সংখ্যক ঐতিহাসিকদের মতে তুস নগরের উপকন্ঠে গায্‌যালানামে কোন গ্রাম ছিল না ; বরং তুৃস প্রদেশের তাহরাননামক স্থানে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি হিজরী ৪৫০ সন মোতাবেক ১০৫৮ খিষ্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন।
নাম ও বংশ পরিচয় :-
ইমাম গায্‌যালীর নাম আবু হামেদ মুহাম্মদ। তার মূল নাম মুহাম্মদ। উপাধি হুজ্জাতুল ইসলাম ও জয়নুল আবেদীন। পিতা মুহাম্মদ। দাদা আহমদ। ইমাম সাহেবের দাদা ছিলেন একজন নেতৃস্থানীয় ও গণ্য মান্য ব্যক্তি। ইমাম সাহেবকে গায্‌যালী বলা হয়, যেহেতু গায্‌যালা অর্থ সুতা ব্যবসা। ইমাম সাহেবের বংশ গত পেশা ছিল সুতা পাকিয়ে বিক্রয় করা।
বাল্যকাল ও শিক্ষাজীবন :-
তৎকালীন সময়ে জ্ঞান আহরনের সুবর্ন সুযোগ থাকা সর্ত্ত্বেও কোন এক অপরিচিত কারনে ইমাম সাহেবের পিতা জ্ঞান অর্জনের সুযোগ লাভে বঞ্জিত হন। এ দুঃখ তাকে সর্বদা তাড়াদিত। তিনি (পিতা) দুই ছেলে মুহাম্মদ ও আহমদকে বাল্য বয়সে রেখে ইন্ত্মেকাল করেন। ইন্ত্মিকালের পূর্বে তার
্থ ফাজিল বি.এ (অনার্স) ২য় বর্ষ (আল-কোরআন এন্ড ইসলামিক স্টাডিজ)
জনৈক বিশ্বস্ত্ম ও অন্ত্মরঙ্গ বন্ধুকে জীবনের সমুদয় সম্পদের অনেকটা ভাগ দিলেন এবং এ অর্থ দিয়ে তার বৎসদ্বয়কে শিক্ষার ব্যবস্থা করার অনুরোধ রাখলেন। সে মুহুর্তে তিনি স্বীয় বন্ধুকে সম্বোধন করে অশ্রু গদগদ কন্ঠে বললেন আমি জ্ঞানার্জনের সুযোগ লাভের পরেও বঞ্জিত হয়ে আজীবন দারুণ অনুতাপে দগ্ধ হয়েছি। অন্ত্মরঙ্গ বন্ধু আপনার নিকট আমার অনুরোধ অনুগ্রহ পূর্বক এ শিশুদ্বয়ের বিদ্যা শিক্ষার সুযোগ করবেন। তারা জ্ঞান অর্জন করতে পারলে, আমি আশা করতে পারি তাদের জ্ঞান লাভের উছিলায় আমার এ অনুতাপ অনেকটা কমে আসবে
তার ইন্ত্মিকালের পর দুই পুত্রই বিশাল জ্ঞানের অধিকারী হয়ে ছিলেন। ফলত: জ্যৈষ্ঠ পুত্র মুহাম্মদ পরে ইমাম মুহাম্মদ গায্‌যালী এবং কনিষ্ঠ পুত্র আহমদ ইমাম আহমদ গায্‌যালী নামে সুনাম কুড়ান। ইমাম সাহেবের পিতা ইন্ত্মেকালের পর তার বন্ধু উভয়কে স্থায়ী মসজিদ সংলগ্ন মক্তবে ভর্তি করান। শিশুদ্বয় শৈশব থেকে অসাধারণ মেধার অধিকারী ছিল বলে কম সময়ে তারা মহাগ্রন্থ আল কোরআন হিফয করেন। তারপর আরবি ভাষায় মনোনিবেশ করেন।
ইমাম সাহেবের পিতা যে অর্থ তার বন্ধুকে দিয়েছিল তা ইতিমধ্যে সমাপ্তি দেখাদিল। বাবার সেই জনৈক বন্ধু বললেন, তোমাদের যে অর্থ ছিল সবশেষ হয়ে গেছে। আমার অবস্থা ক্রমশয় শোচনীয় হতে চলল, তিনি বললেন তোমরা দুই ভাই এখন এমন জায়গায় ভর্তি হও যেখানে মাদরাসা কর্তৃপক্ষ গরীব শিক্ষার্থীদের সকল কিছুর ভার গ্রহন করে। বাবার বন্ধুর পরামর্শ অনুযায়ী ইমাম সাহেব একটি অবৈতনিক মাদ্‌রাসা পেয়ে গেলেন। যা দিল ইমাম সাহেবের পাশ্ববর্তী এলাকার। সেথায় তিনি ফিকহ্‌ এর প্রাথমিক কিতাবাদি হযরত আহমদ ইবনে মুহাম্মদ রাজকানীর নিকট অধ্যয়ন করেন।
অতঃপর ইমাম সাহেব উচ্চ শিক্ষা অর্জন মানসে স্বীয় ভূমি ত্যাগ করে জোরকানশহরে গিয়ে শাস্ত্রবিদ, যুগশ্রেষ্ঠআলেম ইমাম আবু নছর ইসমাঈলের তত্ত্বাবধানে লেখা পড়া শুরু করলেন। তৎকালীন যুগে একটি প্রচলিত রীতি ছিল যা ওস্ত্মাদ পড়াবেন তা লিখে রাখতে হবে। যা লিখে রাখা হয় তাকে তা লিকাতবলা হয়। ইমাম সাহেব যখন জোরকানশহরে পড়া শুনা শেষ করে বাড়িতে রওনা দিলেন। পথিমধ্যে ডাকাত দল তার তা লিকাতসহ সকল কিছু নিয়ে গেল। তিনি চিন্ত্মিত ও পেরেশান অবস্থায় ডাকাত দলের সর্দারকে বললেন; আমাকে কিছু দিতে হবে না। শুধু মাত্র আমার জ্ঞানের জুড়িটা তা লিকাতগুলি দিয়ে দিন। ডাকাত সর্দার বললেন; তুমি কেমন জ্ঞানী? তোমার জ্ঞান কাগজের পাতায়; তারপর তিনি দিয়ে দিলেন। ইমাম সাহেব সর্দারের কথা মনে রেখে ক্ষোভের সাথে সকল তা লিকাতকন্ঠস্থ করে ফেললেন।
তারপর ইমাম সাহেব জ্ঞান আহরনের তার মন আরো তীব্র থেকে তীব্র হতে লাগল। তারপর তিনি তৎকালীন জ্ঞানের শহর খোরাসানের নিশাপুর নিজামিয়া মাদ্‌রাসায় অধ্যয়ন শুরু করেন। যেখানে ইমামুল হারামাইনউপাধি প্রাপ্ত জনৈক কাল জয়ী আলিম ছিলেন। ইমাম সাহেব তার শারগিত্ব লাভ করেন।

শিক্ষকতা :-
ইমাম সাহেবের পান্ডিত্ব ও সকল শাস্ত্রে দখলের খবর ছিল সর্বত্র আলোচিত। এ সব খবর শুনার পর তৎকালীন প্রধান মন্ত্রী নিজামুল হক ইমাম সাহেবকে বাগদানের প্রধান মাদ্‌রাসা, মাদ্‌রাসায়ে নিজামিয়ার অধ্যক্ষ পদে আসিন করেন। তখন তার বয়স ছিল ৩৪ বছর। ইমাম সাহেব প্রসঙ্গত কারণে দুইবার নিজামিয়া মাদ্‌রাসা থেকে পদত্যাগ করে। সর্বশেষ বার বাদ্‌শা তাকে পুন:রায় যোগ দানের জন্য অনুরোধ করে। তিনি বলেন আমি হযরত ইবরাহিম আলাইহিস সালাম এর মাজার জিয়ারত করে তিনটি শপথ করেছি (১) কদাচ কোন বাদ্‌শাহের দরবারে যাব না। (২) কোন বাদ্‌শা থেকে হাদিয়া/বৃত্তি গ্রহণ করবো না। (৩) সবার সাথে বাহাছ/তর্ক করবো না। ইনশাআল্লাহ মৃত্যু পর্যন্ত্ম তা রক্ষা করবো।
তাছাউফে অবদান :-
এ যাবত কাল পর্যন্ত্ম তাসাউফের উপর যত লিখনি প্রকাশ পেয়েছেন তার মধ্যে শতে আশি হলো ইমাম সাহেবের। তিনি হযরত জুনাইদ বোগদানী, বাইজিদ বোস্ত্মামী, শিবলী সহ যুগশ্রেষ্ঠ সুফিয়ায়ে কেরামের বই পড়েছেন। ইমাম সাহেব অধ্যাপনার থেকে ত্যাগ করে তিনি বাগদাদে অবস্থান করেন। তারপর অনেক দিন একাকি বসবাস করেন। তিনি যখন বাগদাদ ত্যাগ করেন তখন উত্তম পোষাকের পরির্বতে একটি মাত্র কম্বল নিয়ে বের হন। সুস্বাদু খাবারের পরিবর্তে শাক লতা পাতার প্রতিবেশি মনোযোগী হন।
পীর গ্রহণ :-
ইমাম সাহেব খুব কম বয়সে ইলমে জাহেরের সাথে ইলমে বাতেনের শিক্ষা নেওয়ার জন্য তৎকালীন সু বিখ্যাত বুজুর্গ, কামেল সূফী, শায়েখ আবু আলী ফারমাদী রহমতুল্লাহি আলাইহি হাতে বায়াত গ্রহণ করেন। তখন তিনি ছাত্র ছিলেন।
লেখনি :-
ইমাম সাহেবের লেখনি ছিল খুরদার। ইমাম সাহেবের দ্রুত কলম চালনা সম্পর্কে ঐতিহাসিক তীব্বী বলেন, “ইমাম সাহেবের আয়ু ও বয়স এর গড় হিসাবান্ত্মে দেখলাম তিনি প্রত্যেহ ১৬পৃষ্ঠা লিখতেন। ইমাম সাহেব প্রায় সকল বিষয়ে গ্রন্থ প্রনয়ন করে দেখেছেন। তিনি দর্শন, তর্ক, মনস্ত্ম ও স্বভাব বিজ্ঞান, নীতি বিজ্ঞান, ইলমে কালাম, ধর্মতত্ত্ব, আধ্যাতিক বিজ্ঞান, তাসাউফের উপর বেশি লেখেছেন। তার উল্লেখ যোগ্য রচনা হলো এহইয়ায়ে উলুমিদ্দিন, কিমিয়ায়ে সায়াদাত, মেনহাজুল আবেদীন, তাফসীর, ফেকাহ, সহ প্রায় চারশত কালজয়ী কিতাব। তিনি ৫৫ বছর জীবিত ছিলেন। ২০ বছর বয়স থেকে কিতাব রচনা শুরু করেন। তন্মোধ্যে ১০/১২ বছর কেটেছে সফরে।
দর্শন ও কালাম :-
তৎকালীন আলিম গন দর্শন ও কালাম এর গতি ইসলামের বিপরীত দিকে বলে আখ্যায়িত করেন। কিন্তু ইমাম সাহেব এসব কথার দাত ভাঙ্গা জবাব দিয়ে তিনি লিখেছেন মীছতাছফাতদর্শন শাস্ত্রে একটি আলাদা বিষয় হিসাবে ইমাম সাহেব দেখিয়ে ছিল। তিনি যুগশেষ দার্শনিক ছিলেন।
সন্ত্মানাদি :-
ইমাম সাহেবের কোন ছেলে সন্ত্মান ছিল না। মাত্র কয়েকজন মেয়ে ছিল। প্রায় সকলে শৈশবে ইন্ত্মেকাল করেন। শুধু শিওলমুনা ব্যতিত
ইন্ত্মেকাল :-
মানুষ মরনশীল। এ কথাটি আরো একবার স্বরণ করিয়ে দেন ৫০৫হিজরি জমাদিউস সানি মোতাবেক ১৯শে ডিসেম্বর ১১১১ খিৃঃ সোমবার খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে নামাজ আদায় করে পূর্বের প্রস্তুতকৃত কাপনের কাপড়টি নিলেন। কাপড়টি চোখের সামনে রেখে বললেন প্রভুর আদেশ শিরোধার্য এর মাধ্যমে।
শেষ কথা :-
ইমাম গায্‌যালী মুসলিম জাতিকে কতটুকু সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন তা অবর্নণীয়। তার দর্শন আজ বিজাতীরাও অনুসরন করছে। মহান ব্যক্তি সম্পর্কে বহুজন বহু মতামত ব্যক্ত করেছেন। কেউ কেউ তাকে মুজাদ্দেদও বলেছেন। আসুন ইসলামী দর্শন তথা ইমাম গায্‌যালীর দর্শনের বাস্ত্মবায়ক হিসাবে নিজেকে পরিচিত করি। নিবন্ধের সমাপ্তি ঘটাতে চাই কাব্যরস দিয়ে-
আজান রয়ে গেছে, বেলালী অন্ত্মরের আজান নেই;
দর্শন রয়ে গেছে, ইমাম গায্‌যালীর শিক্ষা নেই
- আল্লামা ইকবাল রহমতুল্লাহি আলাইহি।

- মুহাম্মদ মহিব্বুল্লাহ সিদ্দিকী